জনাব,
বিনীত সম্ভাষণ। কর নীতি ও প্রশাসনের বিষয়ে আপনার আন্তরিক প্রচেষ্টা ও দায়িত্বশীলতা সম্পর্কে আমরা অবগত। তবে সময় এসেছে একটি মৌলিক প্রশ্ন তোলার—রাষ্ট্রের করব্যবস্থা কি ন্যায্যতা নিশ্চিত করছে?
১. এনবিআরের কাঠামোগত পুনর্বিন্যাসের প্রয়োজন
আমার প্রস্তাব—NBR-এর নতুন নামকরণ ও কাঠামো এইরূপ হতে পারে:
- জাতীয় রিসোর্স সার্ভিসেস (পলিসি) — সংক্ষেপে জারিসা (নীতি)
- জাতীয় রিসোর্স সার্ভিসেস (ম্যানেজমেন্ট) — সংক্ষেপে জারিসা (ব্যবস্থাপনা)
নীতিনির্ধারণী ইউনিটের প্রধান হিসেবে একজন স্টেট মিনিস্টার বা ডেপুটি মিনিস্টার মর্যাদার অভিজ্ঞ ব্যক্তি থাকলে বাস্তবভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজতর হবে। উন্নত বিশ্বে এরকম দৃষ্টান্ত রয়েছে।
যিনি নীতিনির্ধারণে থাকবেন তাঁর অবশ্যই মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা, আর্থিক ও অর্থনৈতিক জ্ঞানে দখল, এবং বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন বিনয়ী চরিত্র থাকা প্রয়োজন।
২. প্রত্যক্ষ বনাম পরোক্ষ কর: বৈষম্যের উৎস কোথায়?
বাংলাদেশে এখনো পরোক্ষ কর রাজস্ব আয়ের মূল উৎস, অথচ এর বোঝা গরিব-ধনী সবার ঘাড়ে সমান। যেমন—
- প্রতি লিটার সয়াবিন তেলে ভ্যাট ১৫ টাকা
- বিদ্যুৎ প্রতি ইউনিটে ভ্যাট ২ টাকা
- কাপড় কাচার সাবানে ভ্যাট ৬ টাকা
একজন দিনমজুর এবং একজন ধনকুবের—দুজনকেই একই হারে কর দিতে হচ্ছে!
এটা কি ন্যায্যতার প্রতীক, নাকি শুভঙ্করের ফাঁকি?
অন্যদিকে, প্রত্যক্ষ কর, যেমন আয়কর, সম্পদকর—এইগুলো সমাজে আয় বৈষম্য হ্রাসের কার্যকর হাতিয়ার। ধনীরা বেশী দেবে, গরিবেরা কম দেবে—এই তো ন্যায়ের রূপরেখা। উন্নত বিশ্বে এর সফল প্রয়োগ দেখা যায়।
উদাহরণস্বরূপ:
- যুক্তরাষ্ট্রে ১০,০০০ ডলার আয় করলে ৪০-৫০% কর কাটা হয়
- অথচ বাংলাদেশে সর্বোচ্চ হার ২৫%, গড় কর হার ২০% এরও নিচে
৩. রাজনৈতিক ও সামাজিক চেতনাহীনতা
দেশে কর বৈষম্য নিয়ে কোন রাজনৈতিক দল, বাম সংগঠন, এমনকি ইসলামপন্থী দলগুলোও নীরব।
তারা কেবল ধর্মীয় ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক কথাবার্তায় সীমাবদ্ধ।
প্রশ্ন হলো—এই বৈষম্য দূর করার জন্য কে কথা বলবে?
এনজিও, সিভিল সোসাইটি, একাডেমিক মহলও আশানুরূপ ভূমিকা রাখছে না।
৪. কী করা উচিত?
- পরোক্ষ কর ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা
- প্রত্যক্ষ কর কাঠামো শক্তিশালী করা
- কর নীতিতে সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা
- জনগণকে সচেতন করা: কর ≠ শাস্তি, বরং সমাজ গঠনের দায়িত্ব
উপসংহার
সমাজের গরিব জনগোষ্ঠীকে ন্যায্যতার নামে বৈষম্যের বোঝা চাপিয়ে রাষ্ট্র দায়িত্ব এড়াতে পারে না।
একটি শুল্কহীন ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন বাস্তবায়নে এখনই সময় কর-নীতিকে ঢেলে সাজানোর।
আশা করি আপনি বিবেচনা করবেন—এই চিঠিটি কোনো অভিযোগ নয়, বরং একটি দায়িত্বশীল নাগরিকের পক্ষ থেকে একটি অনুরোধ, একটি আহ্বান।
“কর নীতি যেন কেবল রাজস্ব আহরণ না হয়, বরং তা হোক সমাজ সংস্কারের একটি হাতিয়ার।”
— মোঃ আসাদুজ্জামান
সাবেক কর কমিশনার
বাংলাদেশ

Latest Videos