বাংলাদেশ এখন আর কেবল একটি রাষ্ট্র নয়—এটি হয়ে উঠেছে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক দাবার বোর্ড। বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী এই জনপদে এখন মহাশক্তিগুলোর স্বার্থের দোলাচল। চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র—তিন পরাশক্তির লক্ষ্যবস্তু এখন বাংলাদেশ।
চীন চায় বঙ্গোপসাগরের সী-রুট নিরাপদ রাখতে, যাতে তার জ্বালানি এবং কাঁচামাল আমদানির ধারা ব্যাহত না হয়। এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতিগুলোর একটি চীন, কিন্তু তার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা জ্বালানি নির্ভরতা। সিংহভাগ জ্বালানি আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে, আর সেই রুটই বঙ্গোপসাগর হয়ে চলে যায় ভারত মহাসাগর বরাবর। এই রুটে যুক্তরাষ্ট্রের ডিয়েগো গার্সিয়ার নেভাল বেস, ভারতের আন্দামান-নিকোবরের সামরিক উপস্থিতি—সব মিলিয়ে চীনের জন্য এক অস্বস্তিকর পরিবেশ।
অন্যদিকে ভারত মনে করে, বাংলাদেশ যদি তার নিয়ন্ত্রণে না থাকে বা অন্ততপক্ষে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক না থাকে, তাহলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ‘সেভেন সিস্টার্স’ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে। তাই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি থেকে শুরু করে কূটনৈতিক নীতিতেও ভারত হস্তক্ষেপ করে চলেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ভিন্ন। তারা চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভকে বাধা দিতে চায়। এজন্য ভারত মহাসাগর ও তার শাখা বঙ্গোপসাগরের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চায়। কোয়াড জোট গঠন, মিয়ানমার প্রসঙ্গে হস্তক্ষেপ, এবং বাংলাদেশের প্রতি অতিমাত্রায় কূটনৈতিক আগ্রহ—সবই চীনকে ঠেকানোর কৌশল মাত্র।
এমন এক জটিল আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপ হতে হবে অত্যন্ত পরিমিত, সুপরিকল্পিত ও স্বার্থ-সচেতন। অতীতে কিছু সিদ্ধান্ত যেমন—আদানি চুক্তি, সীমান্ত হত্যা বিষয়ে দুর্বল প্রতিক্রিয়া, শুল্কমুক্ত ট্রানজিট সুবিধা প্রদান—সমালোচিত হয়েছে স্বার্থবিরোধী বলে। এখন সময় এসেছে নতুন করে পররাষ্ট্র নীতি পুনর্মূল্যায়নের।
জনগণের পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে—সরকারের পরামর্শদাতা হিসেবে কিছু বিচক্ষণ, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হোক। পাশাপাশি কিছু এনজিওঘনিষ্ঠ অদক্ষ উপদেষ্টাকে অপসারণেরও সময় এসেছে। আমরা ড. ইউনুস মহোদয়ের কাছে এ বিষয়ে দৃঢ় নেতৃত্বের প্রত্যাশা করি।
কারণ এই সরকার জনগণের সরকার। এবং ৯৫% জনগণ চায়—এই সরকার সফল হোক।
ফিলিস্তিন: এক অব্যক্ত বেদনার নাম
ফিলিস্তিনের ইস্যুতে পশ্চিমা বিশ্বের নৈতিক দেউলিয়াপনাও আজ নগ্নরূপে উন্মোচিত। যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রের বুলি আওড়ালেও বাস্তবে তাদের পররাষ্ট্রনীতি ইসরায়েল-ঘেঁষা ও জায়নবাদী লবির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। জাতিসংঘে ফিলিস্তিনপন্থী প্রস্তাব বারবার ভেটো করে তারা প্রমাণ করেছে—ন্যায়বিচার নয়, স্বার্থই তাদের পরম আদর্শ।
গাজায় আজ নির্বিচারে নারী-শিশু হত্যা হচ্ছে, অথচ তথাকথিত মানবাধিকারের ধ্বজাধারীরা নিরব। বরং কেউ কেউ এক ধাপ এগিয়ে গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের উৎখাতের প্রস্তাব দিচ্ছে!
এখন প্রশ্ন হলো—মুসলিম বিশ্ব কী করছে?
সৌদি নেতৃত্বাধীন মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্রগুলো আল্লাহর দেওয়া পেট্রোডলারের মোড়কে আবদ্ধ, কিন্তু বৈশ্বিক মুসলিম জনসংখ্যার কল্যাণে কার্যকর কোনো ভূমিকায় তারা নেই। আধুনিক শিক্ষায়, প্রযুক্তিতে, সামরিক সক্ষমতায়, গণতন্ত্রে—এদের অবস্থান শোচনীয়। বাংলাদেশের মতো মুসলিম প্রধান রাষ্ট্রে শিক্ষাব্যবস্থা বা প্রযুক্তি খাতে কোনো উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ নেই। ইমিগ্রেশন নীতিতেও তারা অত্যন্ত রক্ষণশীল, অথচ পশ্চিমা দুনিয়ায় বাংলাদেশ-ভারতের লাখ লাখ মানুষ স্থায়ীভাবে বসবাস করছে।
এ প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠে—এই রাজতন্ত্রগুলো আদৌ মুসলিম আদর্শে চলছে কি?
মুসলিম উম্মাহর একতা ছাড়া ফিলিস্তিন মুক্তি সম্ভব নয়। তুরস্ক, ইরান, পাকিস্তান বা মালয়েশিয়ার মতো কিছু দেশ নিজেদের সামরিক ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে এগিয়ে নিয়েছে। তবে সম্মিলিত উদ্যোগ, সম্মিলিত কণ্ঠ ছাড়া ফিলিস্তিনিদের ভাগ্যে আর কোনো পরিবর্তন আসবে না।
শেষ কথা, বাংলাদেশকে এখন হিসাব-নিকাশ ছাড়া এক ইঞ্চিও চলা যাবে না। আর ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে, মুসলিম উম্মাহকে এখনই এক হতে হবে—নইলে ভবিষ্যত আরও ভয়াবহ।
মোঃ আসাদুজ্জামান
আহ্বায়ক – কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ

Latest Videos