একটি জাতির ক্রান্তিকালে নাগরিক ভাবনা

দেশ আজ এক ভয়াবহ ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে।

একদিকে ভূরাজনৈতিক চাপ ও পাল্টা চাপ, জাতিসংঘে গৃহীত সাম্প্রতিক প্রস্তাব, রোহিঙ্গা সংকটের জটিল পরিস্থিতি, সার্বভৌমত্ব নিয়ে উদ্বেগ— অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে সংস্কার নিয়ে মতপার্থক্য এবং তথাকথিত করিডর বাস্তবতার অনুপস্থিতিতে জন্ম নিচ্ছে নতুন নতুন বিভ্রান্তি।

একটি উদ্বেগজনক দিক হলো, দেশের সর্বোচ্চ আইনাঙ্গন ও বিচারব্যবস্থাতেও ‘মব জাস্টিস’-এর প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে— যেখানে নাগরিকরা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আশায় ছুটছেন, কিন্তু ফিরে আসছেন আশাভঙ্গের হতাশা নিয়ে।

সম্প্রতি সেনাপ্রধানের কিছু মন্তব্য ও কর্মকাণ্ড জনমনে বহুমাত্রিক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। রাস্তায় রাস্তায় দাবিদাওয়া, বিক্ষোভ, ইউটিউব ও টকশোতে আলোচনার নামে কখনো কখনো বিশোধগার— সব মিলিয়ে দেশে আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা যেন ছায়া ফেলেছে।

সাধারণ মানুষ এসব জটিল সমীকরণ বুঝতে চায় না, জানতেও চায় না। তারা শুধু চায় সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে, নিরাপদে রাতে ঘুমাতে এবং পরিশ্রম করে আহার জোগাতে। তাদের এই মৌলিক নিশ্চয়তা দেওয়ার দায়িত্ব সরকার বা শাসকগোষ্ঠীর।

কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো— বর্তমান উপদেষ্টা সরকার এই নিশ্চয়তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। কেন এই ব্যর্থতার অভিযোগ? নিচে কিছু পয়েন্টে তা ব্যাখ্যা করছি:

১. সরকার গঠনে প্রাথমিক ত্রুটি:
অভ্যুত্থান বা বিপ্লবের পর সংবিধানের গণবিরোধী কালো অনুচ্ছেদগুলো বাতিল করে, একটি প্রকৃত বিপ্লবী সরকারের গঠন প্রয়োজন ছিল। তা না করে একটি দ্বিধান্বিত কাঠামো তৈরি করা হয়েছে।

২. দক্ষ নেতৃত্বের অভাব:
অভিজ্ঞ, দুরদর্শী, সাহসী ও দেশপ্রেমিক নাগরিকদের নিয়ে সরকার গঠন করার পরিবর্তে কিছু অযোগ্য ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যাদের ওপর সাধারণ নাগরিকদের আস্থা নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব নিয়ে আলোচনা থাকলেও প্রধান উপদেষ্টা বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করেছেন।

৩. দলীয় সুবিধাভোগীদের ষড়যন্ত্র:
পূর্ববর্তী ফ্যাসিস্ট সরকারের কিছু সুবিধাভোগী, দিল্লি-ঘেঁষা নেতারা, এবং তাদের বিদেশি মিত্রদের আধিপত্য রক্ষার ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় সদিচ্ছা ও সাহস দেখানো হয়নি।

৪. ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ ও সহযোগী সংকট:
সরকার গঠনের শুরুতে যারা সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, পরবর্তীতে স্বার্থ-সংঘাতে তারা পিছু হটেন এবং সরকারের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিতে শুরু করেন।

৫. সাবধানতা ও সতর্কতার অভাব:
বাংলাদেশের মতো একটি একক ভাষা ও সংস্কৃতির দেশে আইন প্রণয়ন, নীতিমালা গ্রহণ এবং বিচারব্যবস্থা প্রয়োগে অতিসাবধানতা প্রয়োজন। দুর্নীতিবাজদের বিচার চাই— তবে ঢালাওভাবে মিথ্যা মামলায় মানুষকে আসামী বানানো যাবে না। এতে প্রকৃত অপরাধীরা বেঁচে যায়।

বাস্তবতাঃ
বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সর্বগ্রাসী শাসনের ফলে সমাজে নৈতিক অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। সমাজে এখন সৎ, দৃঢ়চেতা মানুষ পাওয়া দুষ্কর। এই বাস্তবতায় দক্ষিণ আফ্রিকার “ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন” মডেল অনুসরণ করে একটি বিশেষ কমিশন গঠন করে, অবৈধ সম্পদশালীদের অর্থনৈতিকভাবে দায়ভার দিয়ে সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

প্রশ্ন হচ্ছে:
এত অসংখ্য আর্থিক দুর্নীতির মামলা করলে জেলে জায়গা হবে কোথায়? অথবা জেলে পাঠালেই কি সমাধান হবে? বরং সমাজের মূল্যবোধকে ধ্বংস করার এই সুপরিকল্পিত প্রক্রিয়াকে চিহ্নিত করে মোকাবেলা করতে হবে। বিদেশি শক্তির অদৃশ্য প্রভাবকেও অস্বীকার করা যায় না।

শেষ কথা:
এই সংকটে আমাদের সকলকে দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে একটি কথা মনে রাখতে হবে—

“ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়।”

আসুন, সকলে মিলে এই দেশ ও সমাজকে রক্ষা করি। শান্তি ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হই। আল্লাহ যেন আমাদের সহায় হন।

লেখকঃ
মোঃ আসাদুজ্জামান
আহবায়ক, কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ (একটি অরাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম)
এবং
সাবেক কর কমিশনার

একটি জাতির ক্রান্তিকালে নাগরিক ভাবনা | Asaduzzaman