দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি অত্যন্ত সমৃদ্ধ। নানা জাতি, ভাষা ও ধর্মের সহাবস্থানে গড়ে উঠেছে এই অঞ্চলের সমাজ কাঠামো। বিশেষ করে ভারত বহুদিন ধরে নিজেকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ (সেকুলার) রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরেছে, যেখানে বহু ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষ সহাবস্থান করে আসছে। কিন্তু বিগত এক যুগ ধরে দেশটির শাসনক্ষমতায় থাকা বিজেপি সরকারের অধীনে ভারতের রাষ্ট্রীয় চরিত্র ক্রমেই কমুনাল বা ধর্মভিত্তিক হয়ে উঠছে, যা শুধু ভারতের জন্যই নয়, গোটা উপমহাদেশের জন্যও এক অশনিসংকেত।
বিশ্বের যেখানেই হোক না কেন, ধর্মীয় উগ্রতা মানবতার শত্রু। ধর্মের নামে হিংসা, গোঁড়ামি ও বর্ণবাদ কখনো কোনো সমাজকে উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে পারে না। বরং মানবিক সহনশীলতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের মধ্যেই রয়েছে শান্তি ও উন্নয়নের চাবিকাঠি।
ভারত আজ একটি ‘প্রব্লেম্যাটিক স্টেট’ হয়ে উঠেছে। তার প্রায় সব প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথেই সম্পর্কে টানাপোড়েন বিদ্যমান। এর কারণ বিশ্লেষণে দেখা যায়—ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও জনগণের চিন্তা-চেতনায় একধরনের পুরাতনত্ব, ধর্মীয় ও প্রাদেশিক সংকীর্ণতা কাজ করছে। কৌটিল্য নীতি বা শাস্ত্রীয় কৌশল এখন আর কার্যকর নয়; প্রয়োজন সময়োপযোগী, আধুনিক ও উদার পররাষ্ট্রনীতি।
গান্ধী ও নেহরুর মতো সর্বজনগ্রাহ্য জাতীয় নেতা আজ ভারতের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে অনুপস্থিত। এখনকার নেতারা মূলত প্রাদেশিক বা সেক্টোরাল নেতা, যাদের মধ্যে একটি বৃহৎ রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো উদারতা ও দূরদর্শিতা অনেকাংশেই অনুপস্থিত। এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন জাগে—গুজরাট দাঙ্গার সঙ্গে যাঁর নাম জড়িত, এমন একজন নেতা কীভাবে ভারতের মতো বৃহৎ একটি রাষ্ট্রের নেতা হিসেবে নির্বাচিত হন?
যে ভারত একসময় ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক ছিল, সেই ভারত এখন কমুনাল রাষ্ট্রীয় চরিত্র গ্রহণ করেছে। এই অবস্থান নিয়ে তারা দক্ষিণ এশিয়ার নেতৃত্ব নিতে চায়—এটি কতটা যৌক্তিক? বর্তমান সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (EU) মতো একটি সমন্বিত জোট দক্ষিণ এশিয়াতেও গড়ে তোলা সম্ভব হতো, যদি এখানে উপযুক্ত নেতৃত্ব থাকত। এ অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলো এবং বিশেষ করে জনগণ পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমঝোতার ভিত্তিতে একে অপরের সঙ্গে উন্নয়ন ভাগ করে নিতে পারত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, নেতৃত্বের অদূরদর্শিতা, পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থবোধ এ সম্ভাবনাকে রুদ্ধ করে রেখেছে।
প্রকৃতপক্ষে, দক্ষিণ এশিয়ার জনগণ ভুগছে নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণে। রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়েও যেন একপ্রকার ‘জনগণের সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার দোটানা’ কাজ করছে। আদর্শ নেতৃত্বের কাজ হওয়া উচিত—জনগণের সর্বোচ্চ মঙ্গল নিশ্চিত করা। কিন্তু বর্তমানের মোদি, হাসিনা কিংবা শাহবাজের মতো নেতৃত্ব দিয়ে কোনো বৃহৎ আঞ্চলিক ঐক্য বা সহযোগিতা সম্ভব নয়। এঁরা সবাই তাদের নিজ নিজ রাজনৈতিক অবস্থান ও আদর্শিক সংকীর্ণতায় সীমাবদ্ধ, যাদের দিয়ে মানুষের মৌলিক অধিকার ও আঞ্চলিক সমৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়।
ড. ইউনূসের মতো ব্যক্তিত্বের উদারতা ও আন্তর্জাতিক সংযোগ থাকলেও রাজনৈতিক পরিপক্বতা ও নির্বাচনী বৈধতা না থাকায় তিনিও রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রে পূর্ণ সক্ষম নন। তাই আমি মনে করি—দক্ষিণ এশিয়ার জনগণকে ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। একদিন হয়তো এমন একজন নেতা আসবেন যিনি জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারবেন, ধর্ম-বর্ণ-জাতি-পারস্পরিক বৈচিত্র্যকে সঙ্গে নিয়ে একটি মানবিক, সমৃদ্ধ এবং শান্তিপূর্ণ অঞ্চল গড়ে তুলবেন।
আমাদের প্রয়োজন একে অপরকে “এক মানব পরিবার” হিসেবে ভাবার মানসিকতা এবং পারস্পরিক সহযোগিতার নীতিতে আস্থা রাখা। তবেই সম্ভব হবে একটি Win-Win পরিস্থিতি সৃষ্টি করা। তাই আজ সময় এসেছে দক্ষিণ এশিয়ার জনগণকে একজোট হয়ে নিজেদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সংগঠিত হওয়ার—এই বিশ্বাস নিয়েই বলছি:
“মানুষ মানুষের জন্য,
মানুষ মহিয়ান—
সবার উপরে মানুষ সত্য,
তাহার উপরে নাই।”
আসুন, এই মূল্যবোধকে সামনে রেখে দক্ষিণ এশিয়ার জনগণ ঐক্যবদ্ধ হই, অগ্রসর হই, এবং নেতৃত্বের উপর চাপ সৃষ্টি করে জনগণের স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার পরিবেশ নিশ্চিত করি।
আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
মোঃ আসাদুজ্জামান
আহ্বায়ক – কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ

Latest Videos